হৃদরোগে আঞ্জিওপ্লাস্টি ও বাইপাস অপারেশনের প্রহসন
সুন্দরবনের বাসিন্দা, বছর চল্লিশের এক ভদ্রমহিলা বুকের ব্যথায় ভুগছিলেন। স্থানীয় চিকিৎসকের চিকিৎসায় মন্দ ছিলেননা। তার দুশ্চিন্তাগ্রস্ত পরিবারবর্গ তাদের প্রিয় আত্মীয়ার রোগমুক্তির জন্য অর্থ সংগ্রহ করতে বেশ কিছুটা সময় নিলো। মিডিয়া আর বিজ্ঞাপনের দৌলতে, আজকাল চিকিৎসা বিষয় উপদেশ কেবলমাত্র পারিবারিক চিকিৎসকের উপর নির্ভরশীল নয়। এঁরা কলকাতায় এলেন। কাগুজে বিজ্ঞাপনে আর রাস্তার মোড়ের হোর্ডিংয়ে রোগমুক্তির মূল্য দেওয়াই থাকে। বিজ্ঞাপনে এঁরা আরও জানতে পারলেন, দেরী মোটেই করা যাবেনা। নিজেদের এই প্রচেষ্টাকে ধন্যবাদ দিয়ে, ভাবলেন, এ যাত্রা বোধহয় তাদের আত্মীয়া বেঁচেই গেলেন। এক বেসরকারি হাসপাতালে খুব সহজেই চিকিৎসা শুরু হয়ে গেল। চিকিৎসকের সঙ্গে যথেষ্ট মানবিক আলোচনার সুযোগ না পেলেও, তৎপরতার সাথে নানাবিধ পরীক্ষানিরীক্ষা সারা হল দু’দিনের মধ্যেই। রুগীর পরিবারবর্গ বিস্ময়ের সাথে দেখলেন, স্বল্পভাষী গম্ভীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক খুব বিশ্বাসযোগ্যভাবে কমপিউটারে চলমান ছবিতে প্রথমে হৃদস্পন্দন দেখালেন ও পরে একটা সরু রক্তনালী দেখালেন। রুগীর পরিবারবর্গ যেটুকু বুঝলেন, ভয় পেলেন তার চেয়ে দশগুন। উপলদ্ধি করলেন, আত্মীয়াকে বাঁচাতে হলে সত্তর শতাংশ সরু হয়ে যাওয়া রক্তনালীতে আঞ্জিওপ্লাস্টি করে ষ্টেন্ট (ওষুধ মেশানো এক ধরনের খাঁচা, যেটা সদ্য মোটা করে দেওয়া রোগগ্রস্ত রক্তনালীকে পুনরায় সরু হতে বাধা দেয়) প্রতিস্থাপন করতে হবে। চিকিৎসার খরচের এই বহরটা বিজ্ঞাপনে ছিলোনা। এঁরা প্রস্তুতও ছিলেন না। এক অন্য ধরনের বুকের কষ্ট পরিবারের সব সদস্যকে আক্রান্ত করলো। ঋণভারে জর্জরিত পরিবারটি সুদৃশ্য মলাটে বন্দী একতারা কাগজ ও একটি আঞ্জিওপ্লাস্টির চাকতি (সিডি) নিয়ে অচেনা শহরে দিশেহারাভাবে ঘুরতে লাগলেন। উপরের ঘটনাটা কল্পিত নয়, নাম উল্লেখ না করে নিজের সাম্প্রতিক অভিজ্ঞতা পেশ করলাম। ঘটনাটার পরবর্তী অংশটিতে নাটকীয়তা নেই। কারণ রুগীর বুকের ব্যথার কারণটা মামুলি, হৃদরোগ নয়। এটা বোঝার জন্য রুগীর সাথে কথা বলাটাই যথেষ্ট আর সন্দিহানদের সন্দেহমুক্ত করার জন্য অনেক অপেক্ষাকৃত সস্তার পরীক্ষা (ট্রেডমিল টেস্ট) আছে। হৃদপিন্ডের রক্তনালীতে ব্লকমাত্রই যে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টিযোগ্য হৃদরোগ নয়, পরবর্তী আলোচনায় সেটা নিবেদনের চেষ্টা করব।
বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি, সামগ্রিকভাবে যে চিকিৎসা পদ্ধতি গুলোকে রিভাস্কুলারাইজেশন বলা হয়, তাতে হৃদরোগ সারে কী? পিত্তথলিতে পাথর, অখবা প্রাথমিক পর্যায়ের কতিপয় কর্কট (ক্যান্সার) রোগ হলে নির্দ্বিধায় শল্য চিকিৎসা প্রয়োগ করা হয়, কারন সে ক্ষেত্রে রোগ নিরাময় সম্ভব। হৃদরোগের ক্ষেত্রে তেমনটি হবার নয়। কারন হৃদরোগের ক্ষেত্রে, রোগের লক্ষণ প্রকাশ হবার পর, সেটা আর আঞ্চলিক রোগ থাকেনা। হৃদরোগের সুচিকিৎসার এই আপাত জটিল সিদ্ধান্ত নেবার দায় নিয়ে আম জনতার মাথা ঘামানোর প্রয়োজন হত না, যদি সাধারন মানুষের মধ্যে হৃদরোগ সম্বন্ধে উৎকন্ঠা মেশানো ভ্রান্ত ধারনা না থাকত, আর সেটাকে অধিকাংশ অসৎ চিকিৎসা পরিষেবা অপব্যবহার না করত।
হার্ট এটাক, বা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার ঘটনা আজকাল বেশ বেড়ে গেছে। এটা বোঝার জন্য পরিসংখ্যানের প্রয়োজন হয় না। বিগত পঞ্চাশ বছরে সারা বিশ্বে হৃদরোগীর সংখ্যা ক্রমশঃই বেড়ে চলেছে। ভারতবর্ষে এই বৃদ্ধি লক্ষ করা যাচ্ছে গত তিন দশক ধরে। যদিও এটা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রতিরোধযোগ্য, আজকের আলোচনাটা হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পরের প্রমান নির্ভর (evidence based) চিকিৎসা বিষয়েই সীমাবদ্ধ রাখবো।
হৃৎপিন্ড একটি ঊচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন পাম্প, যেমনটির নকল মানুষ এখনো পরীক্ষাগারে তৈরি করতে পারেনি। হৃৎপিন্ডের মধ্যেকার প্রত্যঙ্গগুলোর সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা অবান্তর ও নিষ্প্রয়োজন। এটুকু জানলেই প্রাসঙ্গিক যে, হৃৎপিন্ড নামক পাম্পটির মধ্যে দুটো ভাগ আছে। ডান দিকের পাম্পটা ব্যবহৃত (নামকরণভেদে দূষিত) রক্ত শরীরের সমস্ত অংশ থেকে টেনে এনে ফুসফুসে পাঠায় অক্সিজেন সংগ্রহ ও কার্বনডাই অক্সাইড বর্জনের জন্য। বামদিকের পাম্পটা ফুসফুস থেকে পরিশোধিত রক্ত সংগ্রহ করে শরীরের সমস্ত অঙ্গে পাঠায় পুনরায় ব্যবহারের জন্য।
হৃৎপিন্ডের মধ্যে আছে চারটি প্রকোষ্ঠ। এক একটি পাম্পের ভাগে দুটি করে। বামদিকের পাম্পটির উপর গুরুদায়িত্ব দেওয়া আছে। বাম নিলয় (লেফট্ ভেন্টট্রিকল্), অর্থাৎ, যে পাম্পটির বিরামহীন কাজের দৌলতে বেঁচেবর্তে আছি, সেটি একটি কমলালেবুর আকারের গোলাকার বিশেষ ক্ষমতা সম্পন্ন মাংসপিন্ড, যার ভেতরটা ফাঁপা। শরীরের প্রয়োজন অনুযায়ী, নির্ভুলভাবে, অক্সিজেন সংপৃক্ত রক্ত পাম্প করে যায় সুনির্দিষ্ট সময় অন্তর। বামদিকের পাম্পের দুমুখে দুটো ভালব্। রক্তের স্রোতের বিপরীতে দুইপাতা বিশিষ্ট ‘মাইট্রাল ভালব্’ রক্তের বিপরীতমুখী স্রোতকে আটকায় আর পাম্প থেকে নির্গমনের পথে ‘এওরটিক ভালব্’ হৃদস্পন্দনের মধ্যবর্তী সময় রক্তকে বাম নিলয়ে ফেরত আসা আটকায়। দক্ষিন নিলয়ে (রাইট ভেন্টট্রিকল) ঠিক এমনতরো দুটো ভাল্ব আছে – ট্রাইকাসপিড ও পালমোনারি নামে। হৃদরোগে আক্রান্ত হবার পর কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ক’টা ভাল্ব আক্রান্ত হয়েছে। জেনে রাখা যাক, হৃদরোগে আক্রান্ত রুগীদের ভাল্ব অক্ষত থাকে, রোগটা হয় হৃদপিন্ডের রক্ত সরবরাহকারী রক্তনালীতে।
হৃৎপিন্ডের বিরামহীন এবং নির্ভুল কাজের জন্য প্রয়োজন সুস্থসবল হৃৎপিন্ডের মাংসপেশী এবং এতে রক্ত সরবরাহকারী নালী গুলোর সুস্থতা। একক ভাবে মাংসপেশীর অসুস্থতা বিরল। রক্তনালীর অসুখই হৃদরোগের অসুস্থতার প্রধান কারণ। যদিও, হৃৎপিন্ডের মধ্যে অক্সিজেন এবং রসদ (গ্লুকোজ) সংপৃক্ত রক্তের অভাব নেই, কিন্তু প্রাকিতিক নিয়মে, হৃৎপিন্ডের মাংসপেশী সেই রক্ত ব্যবহার করেনা। যেমন করে ব্যাঙ্ক কর্মী ব্যাঙ্কে বসে যে টাকা নাড়াচাড়া করে, সেটা সে ব্যবহার করে না; তার জন্য, আলাদা বন্দোবস্ত থাকে। হৃৎপিন্ডের জন্য এই আলাদা সরবরাহটা আসে আলাদা রক্তনালীর মাধ্যমে। এই রকম প্রধান তিনটি রক্তনালী তার শাখাপ্রশাখার মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের মাংসপেশীকে রক্ত সরবরাহ করে থাকে। এই রক্তনালীগুলোকে বলে করোনারি আর্টারি।
হৃদরোগে মূলতঃ হৃৎপিন্ডের মাংসপেশী অকেজো হলেও, এটা কোনোমতেই একক ভাবে কেবলমাত্র হৃৎপিন্ডের রোগ নয়। মূলতঃ এটা রক্তনালীর রোগ যার বৈজ্ঞানিক নাম অ্যাথেরোস্-ক্লেরোসিস (atherosclerosis)। অর্থাৎ, মূল রোগটা হল অ্যাথেরোস্-ক্লেরোসিস, আর হৃদরোগ তার বিবিধ রোগের মধ্যে একটি। এই বহুমুখী রোগের বিশেষত্বটা মনে রাখলে হৃদরোগের সুচিকিৎসার যুক্তিগ্রাহ্য আলোচনাটা বোঝা যাবে।
উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, রক্তে মাত্রাতিরিক্ত কোলেস্টেরল, স্থুলতা, তামাকের ব্যবহার, শারীরিক পরিশ্রম-বিমুখতা ইত্যাদি একাধিক অস্বাস্থ্যকর উপাদানের ক্রমাগত এবং সম্মীলিত প্রভাবে রক্তনালীর মধ্যে চর্বিজাতীয় পদার্থ জমতে শুরু করে। ক্রমে ক্রমে চর্বিজাতীয় পদার্থের মাত্রাবৃদ্ধি হতে থাকে আর চর্বি-নিঃসৃত ক্ষতিকারক হরমোনের প্রভাবে অ্যাথেরোস্-ক্লেরোসিস তৈরির অন্যান্য উপকরণ জমা হয়ে রক্তনালীর দেওয়ালটা মোটা হতে থাকে এবং রক্তনালীর ভেতরে এক ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হয়। রক্তনালীর এই অসুখটা কোনমতেই কেবলমাত্র হৃৎপিন্ডের রক্তনালীর কোন এক ক্ষুদ্র অংশে সীমাবদ্ধ থাকেনা বরং হৃৎপিন্ডের রক্তনালী সহ মস্তিস্ক, বৃক্ক (কিডনি) এবং পায়ের রক্তনালীতে ছড়িয়ে পরে। অর্থাৎ, কেবল মাত্র হৃৎপিন্ড নয়, সুচিকিৎসার লক্ষ্য হতে হবে সমস্ত রক্তনালী। যেহেতু রোগহীণ হৃদয় আর মস্তিষ্কের উপর নীরোগ, সুস্থ ও দীর্ঘজীবন নির্ভর করে, এটা মনে করা প্রাসঙ্গিক হবে যে, কর্মস্থলে কর্মক্ষমতা নির্ধারন অথবা জীবনবীমার প্রিমিয়াম নির্ধারনের ক্ষেত্রে রক্তনালীর বয়সই বিবেচ্য হওয়া উচিত।
হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়াটা আপাত দৃষ্টিতে একটা হঠাৎ দুর্ঘটনা বলে মনে হলেও, চিকিৎসকরা বলে থাকেন, হার্ট এটাক কখনোই হঠাৎ হয়না; এর পিছনে থাকে বহু বছরের প্রস্তুতি। যে দুর্ভাগা আজ হৃদরোগে আক্রান্ত হলো, গড়পড়তা ১০ থেকে ৩০ বছরের আগে তার রোগের সূত্রপাত হয়ে গেছে। সচেতনার আলোয় সামাজিক অন্ধত্ব দূর করা গেলে এই মারণ রোগ অনেকাংশে নির্মূল করা য।য়। কিন্তু সেটা এক কঠিন কিন্তু আয়াসসাধ্য স্বপ্ন, এক অন্য আলোচনা।
হৃৎপিন্ডের প্রধান রক্তনালীর (করোনারি আর্টারি) মধ্যেকার রোগের মাত্রা ও ধরন অনুযায়ী হৃদরোগও প্রধান দুই ধরনের। রক্তনালীর ভেতরটা আংশিক ভাবে বন্ধ (ব্লক)হলে শারীরিক পরিশ্রম করার সময় বুকে ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট হয়, যেটাকে অ্যানজাইনা (angina) বলে। রক্তনালীর ভেতরে রোগের মাত্রা অধিক হলে অথবা বিশেষ ধরনের ক্ষত সৃষ্টি হলে রক্তনালী সাময়িকভাবে সম্পূর্ন বন্ধ হয়ে পরে। ফলে ঐ রক্তনালীর উপর নির্ভরশীল হৃৎপিন্ডের অংশ রক্তের অভাবে পাকাপাকি ভাবে অকেজো হয়ে পরে। এটাই মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (myocardial infarction), হার্ট এটাক অথবা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া।
দুর্ভাগ্যত্রমে পাকপাকিভাবে রক্তনালীর এই অষুখ সারিয়ে ফেলা সম্ভব নয় বলে এই দুই ধরণের রোগেই সারাজীবনের জন্য কিছু ওষুধ ব্যবহার করে যেতে হয়। প্রশ্ন উঠতে পারে, যে ওষুধে রোগ সারছে না, তার প্রয়োজন কী? হৃদরোগে যে ওষুধসমূহ ব্যবহার হয় সেগুলো প্রধানতঃ দুটো কাজ করে। প্রথমতঃ, রোগজনিত কষ্টের উপশম করে ও কর্মক্ষমতা বাড়ায়। দ্বিতীয়তঃ, ক্রমবর্ধমান রোগের অগ্রগতিকে শ্লথ করে। এটা জেনে মন খারাপ করার কোন কারণ নেই। এই ওষুধগুলো এতই কাজের যে প্রাথমিক পর্যায়ে হৃদরোগ নির্ণয় করা গেলে এবং সঠিক ওষুধ, সঠিক সময় ধরে ব্যবহার করে গেলে প্রায় নীরোগ মানুষের মত জীবৎকাল নিশ্চিত করা যায়।
প্রয়োজনীয়তার নিরিখে কম কার্য্যকরী কিন্তু বহু বিতর্কিত বলে বাইপাস অপারেশন এবং অ্যানজিওপ্লাস্টির আলোচনা শেষে করছি। আপাতদৃষ্টিতে হৃদরোগীর সরুহয়ে যাওয়া রক্তনালী বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি করে মেরামত করে দিলে লাভ হতে পারে বলে মনে হওয়াটাই স্বাভাবিক। এমনটি আশা করে অসংখ্য পরীক্ষানিরীক্ষার পর বৈজ্ঞানিকরা বুঝেছে, এখনও অনেক কিছু বুঝতে বাকি আছে। অন্যান্য প্রয়োগ বিদ্যার মত, চিকিৎসাবিজ্ঞানের বিভিন্ন প্রযুক্তির কর্মক্ষমতা উপলব্ধি করার দুইটি পর্যায় আছে। প্রথমে চাই প্রযুক্তির যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা ও পরিশেষে একাধিক নিরপেক্ষ ও নিয়ন্ত্রিত সমমাত্রার রোগপরিবেশে তার ব্যবহারিক প্রয়োগের সফলতা প্রদর্শন (randomised clinical trial)। পূর্বে উল্লেক্ষিত হৃদরোগের কারনটা আবার মনে করা যাক – এটা কোন আঞ্চলিক রোগ নয়। মনে করুন, পরিচর্যার অভাবে বাথরুমের অবহেলিত জীর্ন জলের পাইপে মরচে ধরেছে। আপনার নিজের ভালোবাসার বাসা হলে আপনি কেবল দু’এক স্থানের তাৎক্ষনিক মেরামত করে কী নিশ্চিত হতে পারবেন? স্বভাবতঃই আপনি সমস্ত পাইপ পাল্টে ফেলে নিয়মমত রক্ষনাবেক্ষনের বন্দোবস্ত করবেন, যাতে এই দুরবস্থার পুনরাবৃত্তি না হয়। এটা একটা কঠোর সত্য যে, চিকিৎসাবিজ্ঞানের সাম্প্রতিকতম প্রযুক্তিতেও রোগাক্রান্ত রক্তনালী সমূহ পাল্টে ফেলা সম্ভব নয়। অথবা, এমন কোন ওষুধ আবিস্কার করা যায় নি, যেটা দিয়ে রোগাক্রান্ত রক্তনালীগুলোকে সাফসুতরো করে রোগমুক্ত করা যায়। পুনরায় উল্লেক্ষ করি, সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ও ওষুধ দিয়ে হৃদরোগের অগ্রগতিকে শ্লথ করা যায় মাত্র। এটা বুঝতে কোন অসুবিধা হয়না, বাইপাস অপারেশন এবং আঞ্জিওপ্লাস্টি করে কেবলমাত্র একটা তাৎক্ষনিক রোগের উপশম সম্ভব। সমালোচক বিশেষজ্ঞরা অবশ্য আরও একটা কারণে বাইপাস অপারেশন এবং আঞ্জিওপ্লাস্টিপদ্ধতি গুলোর দীর্ঘজীবন প্রদানে সফলতা সম্বন্ধে সন্ধিহান। অন্যান্য কারণের সাথে, বিশেষকরে আঞ্জিওপ্লাস্টি চিকিৎসাপদ্ধতি প্রয়োগকালে, পদ্ধতিগত কারণে, রক্তনালীর মধ্যে নতুন করে ক্ষত সৃষ্টি হয় এবং সেটা পরবর্তীকালে রোগবৃদ্ধির কারণ হয়। অর্থাৎ যুক্তিগ্রাহ্যভাবে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি হৃদরোগের নিরাময়ের বা উপশমের একমাত্র হাতিয়ার হতে পারেনা।
কেবলমাত্র গুটিকয় বিশেষক্ষেত্র ছাড়া, বিগত দুই দশক ধরে উন্নত থেকে উন্নততর প্রযুক্তি উদ্ভাবন সত্ত্বেও বাইপাস অপারেশন এবং আঞ্জিওপ্লাস্টির অসংখ্য প্রয়োগমূলক পরীক্ষানিরীক্ষা (clnical trials) হৃদরোগে আয়ুস্কালবৃদ্ধিতে সফলতা অর্জন করতে পারেনি। পরীক্ষানিরীক্ষা চলতে থাকুক, সেটা চলাটাই নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের প্রথম পদক্ষেপ। কিন্তু অসফল প্রযুক্তির অনিয়ন্ত্রিত এবং যথেচ্ছ ব্যাবহার হবে কেন?
কেবলমাত্র ব্যাবসায়িক কারণে, অত্যন্ত ব্যয়বহুল বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টির পক্ষে ক্রমাগত বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে সুকৌশলে জনমানসে একটা ভ্রান্ত ধারনা তৈরি করা হয়েছে, যেটা কোনমতেই যুক্তিনির্ভর অথবা প্রমাননির্ভর নয়। যেনতেন প্রকারে, অধিকাংশক্ষেত্রে প্রথম সুযোগেই, অপ্রয়োজনীয় আঞ্জিওগ্রাফি নামে পরীক্ষা করে আর অর্ধসত্য তথ্য পরিবেশন করে হৃদরোগীকে খুব সহজে বোঝানো হচ্ছে, হৃদয়ের রক্তনালীতে এক বা একাধিক ব্লক আছে। যে সত্যগুলো সুচতুরভাবে চেপে যাওয়া হচ্ছে, গুটিকয় বিশেষক্ষেত্র ছাড়া, ঐ ব্লকগুলোর মেরামত করলে রুগীর আখেরে কোন লাভ হবেনা, অথবা, বেশ কিছু ক্ষেত্রে, বুকের ব্যাথার কারণ সরু হয়ে যাওয়া হৃৎপিন্ডের রক্তনালী নয়।
যে গুটিকয় বিশেষক্ষেত্রে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি করলে উৎকৃষ্ট অথবা অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবন প্রাপ্তি হয় বলে প্রমাণিত সেটা উল্লেখ করি:
(১) হৃদরোগে আক্রান্ত (হার্ট এটাক, myocardial infarction) হবার পরে প্রথম ২ ঘন্টার মধ্যে রোগসৃষ্টিকারি রক্তনালীর ব্লকটির আঞ্জিওপ্লাস্টি অপেক্ষাকৃত দীর্ঘজীবন প্রদান করে। মনে রাখতে হবে, রক্তনালীর যে কোন ব্লকই হার্ট এটাক করেনা আর হার্ট অ্যাটাক হবার পর ২ ঘন্টা পেরিয়ে গেলে এই রকম ক্ষেত্রে আঞ্জিওপ্লাস্টি কোন কাজে আসেনা।
(২) একাধিক ব্লক ও মধুমেহ রোগগ্রস্ত (ডায়াবেটিস) রুগীর ক্ষেত্রে আঞ্জিওপ্লাস্টি নয়, বাইপাস অপারেশন কোন কোন ক্ষেত্রে দীর্ঘ ও উৎকৃষ্ট কর্মক্ষম জীবন প্রদান করে।
(৩) দৈনন্দিনের সাধারণ কায়িক পরিশ্রমজনিত বুকের ব্যথা অথবা শ্বাসকষ্ট ওষুধ দিয়ে কমানো না গেলে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টিউৎকৃষ্ট কর্মক্ষম জীবন প্রদান করে, যদিও দীর্ঘজীবন প্রাপ্তি হয় না। হৃদরোগজনিত বুকের কষ্ট কমানোর ক্ষেত্রে রিভাস্কুলারাইজেশনের এই দুটো প্রযুক্তির মধ্যে বাইপাস অপারেশনের সফলতা আঞ্জিওপ্লাস্টি চেয়ে বেশী। বাইপাস অপারেশন অথবা অ্যানজিওপ্লাস্টির এই ব্যবহারটা রুগীর বয়স ও কর্মক্ষম হবার প্রয়োজনের উপর নির্ভরশীল। উদাহরণ স্বরূপ বলা যেতে পারে, একজন ৪৫ বৎসর বয়ষ্ক রোজগেরে মানুষ লাখটাকা খরচ করে আঞ্জিওপ্লাস্টি করে কর্মক্ষম হতে পারলে লাভ আছে, যদিও তাকে হয়তো বছর পাঁচেক পরে পুনরায় আঞ্জিওপ্লাস্টি করতে হতে পারে। কিন্তু একজন ৭০ বৎসর বয়ষ্ক অবসরপ্রাপ্ত রুগীকে আঞ্জিওপ্লাস্টির প্রয়োগের আগে সংবেদনশীল মন নিয়ে বোঝাতে হবে, কোন অর্থমূল্যে সে কী পেতে চলেছে। যেহেতু, এই ধরনের হৃদরোগীর ক্ষেত্রে দীর্ঘজীবন প্রদান করা এখনও পর্য্যন্ত সম্ভব হচ্ছে না, উপভোক্তা কম খরচের এবং কম কর্মক্ষম জীবন বেছে নিতেই পারে।
এই প্রসঙ্গে এই তথ্যটা অপ্রাসঙ্গিক হবেনা যে অধিকাংশ ক্ষেত্রে বাইপাস শল্য চিকিৎসার চেয়ে ওষুধের চিকিৎসাটা খরচের সাপেক্ষে অধিকতর কার্য্যকরী (cost effective) । গুটিকয় ক্ষেত্রে রিভাস্কুলারাইজেশনের দুই প্রযুক্তির মধ্যে আঞ্জিওপ্লাস্টি বড় মাপের অর্থমূল্যে অপেক্ষাকৃত উৎকর্ষ কিন্তু ক্ষনস্থায়ী জীবন দেয় এবং প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে পুনরায় আঞ্জিওপ্লাস্টি করার প্রয়োজন হয়। আবার অন্য প্রযুক্তি হিসাবে বাইপাস শল্য চিকিৎসা উৎকর্ষ এবং দীর্ঘতর জীবন দান করে সমমাপের অর্থমূল্যে। তবে সেটা পাওয়া যায় কিছুটা অনিশ্চয়তা ও বাইপাস অপারেশণের পরের দীর্ঘ রোগভোগ আপস করে নেওয়ার মাধ্যমে।
ধরা যাক, কোন এক মধ্যবিত্ত ছোট সুখী পরিবারের একমাত্র রোজগেরে সদস্য হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছে। রোগটা দুই ধরনের হতে পারে।
(১) ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ্ ঃ বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সেটা হার্ট এটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়া নয়, বরং ক্রনিক ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ্ বা এনজাইনা। এই ক্ষেত্রে ওষুধের চিকিৎসাটাই প্রধান। এই ক্ষেত্রে আঞ্জিওগ্রাফি পরীক্ষা করলে সরু রক্তনালীর উপস্থিতি নির্ণয় করা যেতেই পারে, কিন্তু সেটাকে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি করলেই যে উপকার হবে সেটা যুক্তি নির্ভর বা প্রমান নির্ভর নয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শুধু ওষুধের চিকিৎসায় একই অথবা তুলনামূলক ভাবে উন্নততর ফল পাওয়া যায়। আরও উন্নততর প্রযুক্তির প্রয়োগ করতে চাইলে, কিছু বিশেষ পরীক্ষানিরীক্ষা (ট্রেডমিল টেষ্ট, পারফিউশন স্ক্যান, স্ট্রেস ইকোকার্ডিওগ্রফি ইত্যাদি) করে বিশেষ কিছু নিদর্শণ পাওয়া গেলে আঞ্জিওপ্লাস্টিনয়, বাইপাস অপারেশনে অপেক্ষাকৃত উন্নততর ও দীর্ঘজীবন লাভ করা যায়। ইদানিং কালে আঞ্জিওপ্লাস্টিপ্রযুক্তির উন্নতসাধনের ক্রমাগত নতুন নতুন পরীক্ষানিরীক্ষা চলছে। সেগুলোর উৎকর্ষতা প্রমানের অপেক্ষায় আছে এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল।
(২) হার্ট এটাকঃ রক্তনালীর রোগ সম্পর্কিত হৃদরোগের মধ্যে হার্ট এটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার রোগ অপেক্ষাকৃত ভাবে কম। দুর্ভাগ্যক্রমে, হার্ট এটাক হবার পর অনেকগুলো ধাপ পেরিয়ে আঞ্জিওপ্লাস্টির অপারেশন টেবিলে পৌছতে দুই ঘন্টার চেয়েও দেরী হয়ে যায়। তাই, অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রাইমারি আঞ্জিওপ্লাস্টি নামে আয়ুষ্কালবৃদ্ধিকারি প্রযুক্তি ব্যবহার করে লাভ হয় না। হার্ট এটাক হবার পর চার থেকে ছয় ঘন্টা পেরিয়ে গেলে আঞ্জিওপ্লাস্টিকরা অর্থহীন। সেক্ষেত্রে আপৎকালীন অবস্থা থিতিয়ে গেলে, পরবর্তীকালে ট্রেডমিল টেষ্ট, পারফিউশন স্ক্যান ইত্যাদি করে দেখে নিতে হয় বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টিকরলে কোন লাভ হবে কিনা। যেহেতু হার্ট এটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার পর, ভিন্ন আর্থসামাজিক অবস্থার জন্য, অনেক ক্ষেত্রে আমাদের দেশে খুব তাড়াতাড়ি হাসপাতালে পৌছনো সম্ভব হয়না, অথবা পৌছনো সম্ভব হলেও বিশেষ করে অসময়ে, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের উপস্থিতি নিশ্চিত করা যায় না, অথবা প্রযুক্তির ব্যয়ভার বহন সম্ভব হয় না। তাইএই রকম অবস্থার জন্য প্রায় সমমানের বিকল্প ওষুধের চিকিৎসা পদ্ধতি প্রয়োগ করা যায়। সেই সম্পর্কিত বিস্তারিত আলোচনা আজকের বিষয় নয়।
দুর্ভাগ্যক্রমে হৃদরোগের চিকিৎসা সম্পর্কিত কর্মকান্ড, উদ্যোগ, ব্যয় ও মনোযোগ হার্ট এটাক বা হৃদরোগে আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসাকেন্দ্রিক। কোনো হাসপাতালের উৎকর্ষতা সেটার ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিটের মান ও উৎকর্ষতার নিরিখে বিচার্য্য। যদিও কোন জনগোষ্ঠীর সুস্থ হৃদয় নিশ্চিন্ত করার জন্য ক্রনিক ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ্ বা এনজাইনা কে নিশানা করা উচিত। কারণ, পরিসংখ্যান অনুযায়ী, কোন জনগোষ্ঠীতে প্রতি একজন হার্ট এটাকের রুগীর চারপাশে আরও ত্রিশজন ক্রনিক ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজের (এনজাইনা) রুগী হার্ট এটাকের অপেক্ষায় থাকে আর অধিকাংশ ক্ষেত্রে হার্ট এটাক হবার আগে ক্রনিক ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজ্ তার উপস্থিতি জানিয়ে দেয়। আমরা আগেই জেনেছি, এই শেষোক্ত ধরনের হৃদরোগে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টির ভূমিকা নগন্য এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অকাজের। প্রয়োজন শৈশবকাল থেকে সুস্থ জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত হওয়া যা হৃদরোগ নিবারণে সফল বলে প্রমানিত। দুর্ভাগ্যক্রমে যদি সেটা পরিবারের কাউকে আক্রান্ত করে, তার পরবর্তী প্রজন্মের অন্ততএর থেকে শিক্ষা ও অনুপ্রেরনা নিয়ে নিজেদেরকে সুরক্ষিত করা উচিত। প্রথম ধাপের প্রতিরক্ষা বলয় যদি বলবৎ করা নাও যায়, হৃদরোগ তার উপস্থিতি জানান দেয়, তবেও তার মোকাবিলায় বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি সঠিক হাতিয়ার নয়।
সফল চিকিৎসা হল
(১) সুখাদ্য নির্বাচন (স্নেহ জাতীয় খাবার ক্যালোরির হিসাবে শতকরা দশ ভাগের কম, সম্পৃক্ত স্নেহ জাতীয় খাবার (saturated fat) বর্জন আর খাদ্যতালিকায় ভেজানো ছোলা ও ডাল জাতীয় খাবার (legums), বিভিন্ন মরশুমী ফল ও ফাইবার জাতীয় খাবারের অন্তর্ভুক্তি)।
(২) দৈনিক তিন থেকে চার কিলোমিটার হাঁটা।
(৩) স্থূলতা কমানো।
(৪) তামাকের ব্যবহার পুরোপুরি ভাবে বর্জন করা।
(৫) প্রয়োজন বোধে আজীবন ওষুধের ব্যবহার করে রক্তচাপ, মধুমেহ, অতিরিক্ত কোলেস্টেরল নিয়স্ত্রন করা।
(৬) এসপিরিন জাতীয় ওষুধ, যা রক্ত জমাট বাঁধতে বাধা দেয়, ব্যবহার করা।
বিগত দুই দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের উন্নত প্রযুক্তির দ্বারা সারা বিশ্বে হৃদরোগে মৃত্যুর সংখ্যা শতকরা ৪০ ভাগ কমানো গেছে। এর অর্ধেক সুফল এসেছে হৃদরোগের উপাদান, অর্থাৎ উচ্চ রক্তচাপ, মধুমেহ, রক্তে মাত্রারিক্ত কোলেস্টেরল, স্থূলতা, তামাকের ব্যবহার, শারিরীক পরিশ্রম বিমুখতা (cardiac risk factors) নিবারণ কোরে। বাকি অর্ধেক সুফল এসেছে হৃদরোগে রোগাক্রান্ত রুগীদের ওষুধের চিকিৎসা ও পূর্বে উল্লিখিত সঠিক প্রয়োজনে বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি করে।
সুস্থ জীবনযাত্রা প্রনালীর উপকারিতা ব্যাপকহারে সমাদৃত হলেও এবং মুহুর্মুহু এর সপক্ষে উপদেশ দেওয়া সত্ত্বেও কোন এক আশ্চর্য্য কারণে সুস্থ জীবনযাত্রা প্রনালী প্রয়োগে অনীহা হৃদরোগ নিবারনের পথে এক মস্ত বাধা। এর কারন দ্বিবিধ। প্রথমতঃ, এর সুফল তাৎক্ষনিক নয় ও দ্বিতীয়তঃ, এর জন্য প্রয়োজন অভ্যাসের আমূল পরিবর্তন, যেটা টিটেনাস অথবা পোলিওর প্রতিষেধক টিকা নেবার চেয়ে অনেক কঠিন।
বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি মধ্যে তুলনা করতে চাইলে বলতে হয়, হৃদরোগজনিত কষ্ট কমিয়ে উৎকৃষ্ট জীবন প্রদানে অথবা ক্ষেত্র বিশেষে দীর্ঘজীবন প্রদানে বাইপাস অপারেশন আঞ্জিওপ্লাস্টির চেয়ে অধিক সফল। অন্যদিকে, আঞ্জিওপ্লাস্টি প্রযুক্তিটি সরল, অল্প সময়ে সেরে ফেলা যায়, এক বা দুই দিন হাসপাতালে থেকে আবার কাজে লেগে পড়া যায় আর চিকিৎসার পরে বিশেষ কোন কষ্ট হয়না বলে এটি অধিক জনপ্রিয়। তাই, এই তুলনার কোন শেষ উত্তর এখনও জানা নেই। যদি রিভাস্কুলারাইজেশন করার সিদ্ধান্ত নেওয়াই হয়, কেবল রোগের পর্য্যায় বা মাত্রা জানলেই হবেনা। প্রযুক্তির ফলাফল সম্বন্ধে সচেতন রুগীর পছন্দ, চিকিৎসকের প্রশিক্ষন, হাসপাতালের পরিষেবা ও আর্থসামাজিক অবস্থা অনুযায়ী বাইপাস অপারেশন অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টির মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হয়।
এটা স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে, রিভাস্কুলারাইজেশনের এই দুই প্রযুক্তিতে বেশ কিছুটা অর্থ হাতবদল হয় আর হাসপাতাল ও চিকিৎসক সেই কর্মকান্ডের কান্ডারী। সেই বিশাল অর্থের একটা অংশ হাসপাতাল ও চিকিৎসকের হাতেও পৌছে যায় বিনা আয়াশে। চিকিৎসকও যেহেতু এই সমাজের একজন, সেই প্রলোভন ত্যাগ করার মানসিক জোর তাদের অনেকেরই থাকেনা। ফলে অবহেলিত হয় ওষুধের চিকিৎসা আর চলতে থাকে বাইপাস অপারেশণ আর আঞ্জিওপ্লাস্টির অপপ্রয়োগ। ভুগতে থাকে উপভোক্তা হৃদরোগী। এই কুকর্ম কান্ড কেবল মাত্র বেসরকারি হাসপাতাল নয়, সরকারি হাসপাতালে ও ঘটে চলেছে। বাইপাস অপারেশন আর আঞ্জিওপ্লাস্টির প্রয়োজনীয় একবার ব্যবহারযোগ্য জিনিসপত্র এখনও সরকারি হাসপাতাল বিনামূল্যে সরবরাহ করেনা। বহুজাগতিক ব্যবসায়ীদের দালাল বা এজেন্টদের দৌরাত্ব্যে উদ্ধুদ্ব চিকিৎসা ব্যবস্থা রিভাস্কুলারাইজেশন প্রয়োগের ফাঁকফোকর খুঁজে বার করতে বিশেষ পারদর্শী । অনেকে বলে থাকেন, অনেক ক্ষেত্রে রোগী ও তার আত্মীয়স্বজন রিভাস্কুলারাইজেশন করাতে চাপ সৃষ্টি করে। রোগী ও তার আত্মীয়স্বজনদের ধারণা, বাইপাস অপারেশণ অথবা আঞ্জিওপ্লাস্টি না করলে, চিকিৎসায় অবহেলা করা হয়। আসলে সেটা সত্যকে এড়িয়ে যাওয়ার সামিল। যেটা সঠিক পথ বলে মনে করা হচ্ছে, কেবল জনপ্রিয় নয় বলে সেটাকে এড়িয়ে যাওয়া কাপুরুষতা।
দুর্ভাগ্যক্রমে এমন হাসপাতাল বা এমন চিকিৎসকের সন্ধান জানা নেই যেখানে গেলে হৃদরোগীরা প্রতারিত হবেন না। তাই কেবল সমালোচনা করেই ক্ষান্ত হতে হচ্ছে আর এই প্রতিবেদনের পাঠকদের অবহিত করে আশা করতে হচ্ছে, সত্য প্রচারিত হোক, প্রতিষ্ঠিত হোক।
পরিশেষে উল্লেখ করি, দীর্ঘ ১৩১ বৎসর দাপটের সাথে ব্যবসা করার পর, ১৯শে জানুয়ারি, ২০১২ ইষ্টম্যান কোডাক কোম্পানি নিজেকে দেউলিয়া ঘোষনা করেছে। কারণ তারা বৈদ্যুতিন বিপ্লবের সাথে তাল রাথতে পারেনি। উপভোক্তার পরিবর্তিত প্রয়োজনকে অবজ্ঞা করেছে। মানুষের ভালো ছবির প্রয়োজন ছিলো, ডিজিটাল ক্যামেরা অনেক সহজে তাৎক্ষনিক ছবির বন্দোবস্ত করে দেওয়ায়, মানুষ অ্যানালগ ক্যামেরাকে বর্জন করেছে। কোডাক ব্যবসা হারিয়েছে। এটাই বাজারের চিরাচরিত নিয়ম। মানুষ সুস্বাস্থ্য চায়। বর্তমানের দুর্মুল্য, জটিল, স্বাস্থ্যব্যবস্থা, যা কিনা সামগ্রিক ভাবে কোন জনগোষ্ঠীর সুস্বাস্থ্যের পথ দেখায না, তার ভবিষ্যত সম্বন্ধে সন্ধিহান হওয়াটাই স্বাভাবিক। আশা রাখি, ভবিষ্যতের সফল চিকিৎসক, ভালো হাসপাতাল আর সুচিকিৎসা ব্যবস্থা তাদের কর্মকান্ড চার দেওয়ালের বাইরে নিয়ে গিয়ে, পরিষেবা নির্ভর না হয়ে উপভোক্তামুখী হবে আর তাদের সফলতার মাপকাঠি হবে ভিন্ন। কত জটিল রোগ উন্নত মানের শল্যচিকিৎসায় মেরামত করা গেল তা অপ্রাসঙ্গিক হবে। অসুস্থ মানুষটিকে কত কম খরচে এবং সহজ ভাবে দীর্ঘ, সুস্থ ও কর্মক্ষম জীবন উপহার দেওয়া গেল, সর্বোপরি, সামগ্রিক জনগোষ্ঠীকে কত কম আয়াসে সুস্থ রাখা গেল সেটাই হবে সফলতার সঠিক মাপকাঠি।
গৌতম মিস্ত্রী, ৯ই নভেম্বর, ২০১২
নিবন্ধটি পূর্বে উৎস মানুষ পত্রিকায় প্রকাশিত